ভিডিও
বাঁশের কেল্লার মহানায়ক : শহীদ তীতুমীর
১৯ শে নভেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:০২
-ছেলেটা হুমহাম তাড়াহুড়া করে ভাত মুখে পুরছিলো । এত তাড়া তার !! মা ধমক দিয়ে ধীরে সুস্থ্যে খেতে বলে , কিন্তু তার মাথায় তখন অন্য চিন্তা । সংগীরা অপেক্ষা করছে ও পাড়ার সুপাড়ী বাগানে । এমন সময় কে একজন দৌড়ে এসে তার কানে কানে খবরটা দিয়ে যায় , মন্ডলদের বাড়ির পেছনে একটা বাঘের বাচ্চা দেখা গেছে । ভাতের থালা থেকে হাত গুটিয়ে উঠে পড়ে সে । কতদিনের শখ- একটা বাঘের বাচ্চা পুষবে ...
-তীতুমীরের জীবনগাঁথা নিয়ে লেখা কোন এক উপন্যাসের শুরুটা এমন ছিলো । অস্পষ্ট মনে আছে । নাম সম্ভবত "তীতুর লেঠেল " আতা সরকার লেখক ...
-সাইয়্যেদ মীর নীসার আলীর তীতুমীর হবার একটা গল্প-ও আজই শুনলাম । একেবারে ছেলেবেলায় নাকি তিনি রোগা ছিলেন , তাই দাদী গাছের বাকল, লতা, পাতা, শিকড় বেটে তিতা রস বানিয়ে খাওয়াতেন তাকে । অনায়াসে গিলে ফেলতেন তিনি সেই রস । দাদী এখান থেকেই তাকে ডাকতে শুরু করেন তিতা-মীর
-২৭ জানুয়ারী ১৭৮২ সালে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই মহান যোদ্ধার জন্ম হয় । বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী তারিখটা ১৪ ই মাঘ- ১১৮২ । জন্মস্থান চব্বিশ পরগনার হায়দ্রাবাদ । তীতুমীরের বাবা মীর হাসান আলী এবং মা আবিদা রুকাইয়া খাতুন । তীতুমীর হযরত আলী রা: এর বংশধর । তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ শাহাদাত আলী ইসলাম প্রচারোদ্দেশ্যে প্রথম আরব থেকে আসেন । শাহাদাত আলীর পুত্র সাইয়্যেদ আব্দুল্লাহকে জাফরপুরের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেয় দিল্লী প্রশাসন । উনি-ই বিচারকার্যের জন্য "মীর-ইনসাফ" উপাধি পান ....
-১৮ বছর বয়সে কুরআনের হাফেজ হন তীতুমীর । বাংলা - আরবী-ফারসী ভাষায় দক্ষতা অর্জন করার পাশাপাশি একই সাথে একজন ব্যয়ামবীর পালোয়ান হিসেবে পরিচিত হন বন্ধুমহলে । ইসলামী আইন-বিচারব্যবস্থা - দর্শনশাস্ত্রেও পারঙগমতা অর্জন করেন তিনি ...
-মূলত: ১৮২২ সালে হজ্জ্বে যাওয়ার পর থেকেই তীতুমীরের চিন্তাধারার বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয় । বিশ্বমুসলিমের এই মহাসমাবেশের পর তার সাথে দেখা হয় সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভীর সাথে । ১৮২৭ এ তিনি ফিরে আসেন নিজ গ্রামে । শির্ক ও বিদয়াতমুক্ত মুসলিম সমাজ গঠনের দাওয়াতে নেমে পড়েন । মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দিকেও মনোযোগ দেন তিনি । তার কাজ শুরু হয় চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলায় ।
-কিছুদিনের মধ্যেই তৎকালীন সৈরাচারী সাম্প্রদায়িক জমিদারশ্রেনীর সাথে তীতুমীরের টক্কর শুরু হয়ে যায় । নানারকম অপমানজনক ট্যাক্স ধার্য করা হচ্ছিলো । মুসলমানদের দাঁড়ি রাখা .. এমনকি মসজিদের ওপর ট্যাক্স ধার্য করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মদদপুষ্ট অত্যাচারী জমিদার কৃষ্ণদেব রায় । একই সাথে দেবনাথ রায় (গোবরা গোবিন্দপুর) , গৌড়ী প্রসাদ চৌধুরী (নাগপুর), রাজনারায়ণ (তারাকান্দি), কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় (গোবরডাঙ্গা) প্রমুখ হিন্দু জমিদারেরাও সতর্ক হয়ে ওঠে তীতুর আন্দোলনের ব্যাপারে ।
-এসময় তীতুমীর অত্যাচারিত কৃষকদের কে সংগঠিত করে লাঠি-সড়কি জাতীয় দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী গড়ে তোলেন । তার ভাগ্নে শহীদ গোলাম মাসুম ছিলেন এই মুজাহিদ বাহিনীর সেনাপতি ।
- জমিদার কৃষ্ণদেব রায় পার্শ্ববর্তী সরফরাজপুরে (বর্তমান নাম - সর্পরাজপুর) শত শত লোক জড় করে লাঠিসোঁটা, ঢাল-তলোয়ার, সড়কিসহ শুক্রবার জুমার নামাজরত অবস্খায় মসজিদ ঘিরে ফেলে এবং মসজিদে আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিন দু’জন শাহাদত বরণ করেন , আহত হন অসংখ্য । মুসলমানদের মামলায় পুলিশ ঘটনাস্খলে না গিয়ে থানায় বসেই মামলার রিপোর্ট দেয়।
-তিতুমীর তার লোকজন নিয়ে সরফরাজপুর থেকে ১৭ অক্টোবর ১৮৩১ সালে নারকেলবাড়িয়া হিজরত করেন। ২৯ অক্টোবরেই কৃষ্ণদেব নারকেলবাড়িয়া আক্রমণ করে বহু লোক হতাহত করে। ৩০ অক্টোবর এই সংক্রান্ত মামলা দায়ের করতে গেলে কোনো ফল হলো না। ৬ নভেম্বর কৃষ্ণদেব আবার মুসলমানদের ওপর নারকেলবাড়িয়ায় আক্রমণ করল।
-হিন্দু ও ইংরেজদের যৌথ আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাঁশের মজবুত খুঁটি দিয়ে কেল্লা তৈরী করেন । ইতিহাসে এটা ‘তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা’ নামে পরিচিত।
-শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমঝোতা করার সব উপায় ব্যর্থ হবার পর তীতুমীর বারাসাতে ইংরেজ সরকারের বিপক্ষে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । চব্বিশ পরগনার কিছু অংশ , নদীয়া ও ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন । এটাই বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত হয় । বর্নহিন্দুর অত্যাচারে জর্জরিত অনেক হিন্দু কৃষক ও এ বিদ্রোহে ছিলো । বারাসাত বিদ্রোহে গোবরাগোবিন্দপুরের জমিদার নিহত হয় ।
- বারাসাত বিদ্রোহের পর তীতুমীর উপলদ্ধি করেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত লড়াই আসন্ন । ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সরকার কর্নেল স্টুয়ার্ডকে সেনাপতি করে একশত ঘোড়া, তিনশত পদাতিক সৈন্য, দু'টি কামানসহ নারকেলবাড়ীয়াতে রওনা করায় ১৩ নভেম্বর। মেজিষ্ট্রেট আলেকজান্ডার নারকেলবাড়ীয়ায় একজন হাবিলদার, একজন জমাদ্দার, পঞ্চাশ জন বন্দুক ও তরবারীধারী সৈন্য নিয়ে নারকেলবাড়িয়ার কাছাকাছি ভাদুড়িয়ায় উপস্খিত হন। পরে বশিরহাটের দারোগা সিপাহী নিয়ে ভাদুড়িয়ায় আলেকজান্ডারের সাথে মিলিত হয়। প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় মুজাহিদ বাহিনীর সাথে । এতে উভয় পক্ষের লোক হতাহত হয়। যুদ্ধে দারোগা ও একজন জমাদ্দার মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়, বারাসাতের জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট মি: আলেকজান্ডার পালিয়ে বেঁচে যান ।
-পরের দিন ১৪-নভেম্বর কর্নেল স্টুয়ার্ডের নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার প্রধান দরজায় পৌঁছে । স্টুয়ার্ড পথ প্রদর্শক রামচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাস করলেন, 'এই ব্যক্তিই কি তিতুমীর'? রামচন্দ্র, বলল 'হ্যাঁ, সে নিজেকে তিতু বাদশা বলে প্রচার করে। আপনার আগমনে তারা বাহানা পরিবর্তন করেছে।'
-স্টুয়ার্ড রামচন্দ্রকে বলল, 'তিতুমীরকে বলুন, বড়লাট লর্ড বেন্টিংক-এর পক্ষ থেকে আমি সেনাপতি হিসেবে এসেছি। তিতুমীর যেন আমার কাছে আত্মসমর্পণ করে। তবে উত্তরে সে যা বলবে তা আমাকে হুবহু বলবেন।'
-রামচন্দ্র তিতুমীরকে বলল, 'আপনি কোম্পানী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এখন জপমালা ধারণ করেছেন। আসুন, তরবারী ধারণ করে বাদশার যোগ্য পরিচয় দিন।'
-শুনে সাইয়েদ নিছার আলী তিতুমীর বললেন, 'আমি কোম্পানী সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি। হিন্দুদের ন্যায় আমরাও কোম্পানী সরকারের প্রজা। জমিদার নীলকরদেরঅত্যাচার দমন এবং মুসলমান নামধারীদের প্রকৃত মুসলমান বানানোর জন্য সামান্য চেষ্টা করছি মাত্র।'
-তিতুমীরের জবাব শুনে রামচন্দ্র দোভাষী হিসেবে কর্নেল স্টুয়ার্ডকে বলল, 'হুজুর, তিতুমীর আত্মসমর্পণ করবে না, যুদ্ধ করবে। সে বলে, সে তোপ ও গোলাগুলীর তোয়াক্কা করে না। সে আরো বলে, সে তার ক্ষমতাবলে সবাইকে টপ টপ করে গিলে খাবে। সে এই দেশের বাদশা, কোম্পানী আবার কে?'
-দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে রামচন্দ্রের বিশ্বাসঘাতকতায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো । সুশিক্ষিত ইংরেজ সৈন্য মেজর স্কটের পরিচালনায় ও তাদের ভারী কামানের গুলীর সামনে লাঠি আর সড়কির কৃষকসেনারা দাঁড়িয়ে গেলো । বাঁশের কেল্লা ধ্বসে পড়লো । তিতুমীর ও তার মুজাহিদরা হানাদারবাহিনীর কাছে মাথা নত না করে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যান । ১৯ নভেম্বরে শেষ হয়ে যায় তীতুমীরের প্রতিরোধ । শহীদ হন উপমহাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের এই বীরমুজাহিদ ।
__________________________
যেসব পেইজ দেখে লিখতে গিয়ে কিছুটা গোলমাল হয়েগেছে বলে আমার ধারনা ....
No comments:
Post a Comment